২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৫০ পূর্বাহ্ন, ১৮ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি, রবিবার, ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নোটিশ
জরুরী ভিত্তিতে কিছুসংখ্যক জেলা-উপজেলা প্রতিনিধি নিয়োগ দেওয়া হবে যোগাযোগ- ০১৭১২৫৭৩৯৭৮
সর্বশেষ সংবাদ :

রহস্য মানব

রোকেয়া পপি

উর্মি হঠাৎ করে অনুভব করলো ওর পা ধরে কেউ নিচের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
কিছু একটা ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে।

ওরা শিক্ষা সফরে আজকেই কক্সবাজার এসেছে।
সকালের নাস্তা খেয়ে সব বন্ধুরা মিলে সমুদ্র সৈকতে নেমে এসেছে।
দুরন্ত ছেলে মেয়ে গুলোর আনন্দ দেখে কে।
ওরা প্রচন্ড রকম হৈচৈ এ মেতে উঠেছে।
সৈকতে নামার আগে পলাশ একটা ফুটবল কিনে আনছে।
সেটা নিয়ে চলছে খুব মাতামাতি।

ওদের সাথে ওদের কয়েকজন টিচার ও এসেছেন।
তারাও খুব মজা পাচ্ছে এই ভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্র ছাত্রীদের ছেলে মানুষি দেখে।

উর্মি প্রথমে খুব ভয় পাচ্ছিল, পানিতে নামতে।
প্রথমত ও সাঁতার জানে না।
দ্বিতীয়ত ও খুব নরম মনের মেয়ে।
এর আগে ও কখনো এতো কাছ থেকে সমুদ্র দেখেনি।
ওর মা খুব ধার্মিক, পর্দানশীল মহিলা।
তাই পরিবার থেকে কখনো দূরে কোথাও যাওয়া হয় না।
এবার যখন শিক্ষা সফর সমুদ্র সৈকত।
তখন আর উর্মি সমুদ্র দেখার লোভ সামলাতে পারলো না।

অনেক কষ্ট করে বাবার পারমিশন নিয়ে চলে আসলো বন্ধুদের সাথে।

ও চেয়েছিল শুধু পা ভেজাবে।
পানিতে নামবে না।
তাছাড়া আজকে ডেউ গুলো অনেক বড়ো বড়ো।
ঢেউ আসলেই ও দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করে।
কিন্তু জয়ি নাছোড়বান্দা।
ওকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় বেশ কিছুটা দূরে।

উর্মি খুব বাঁধা দেওয়ায় চেষ্টা করে।
দেখ আমি সাঁতার জানি না। আমার হাত ছাড় প্লিজ।
আমার খুব ভয় করছে।

জয়ি হেসে বাঁচে না, উর্মির ছেলে মানুষী কান্ড দেখে।
আরে পাগল সমুদ্র কখনো কাউকে তার কাছে টেনে নেয় না। সে তা বিশাল হৃদয় দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয় তীরে।
সমুদ্রের ঢেউ তোকে টেনে যতো গভীরে নিয়ে যাক, আবার আছড়ে ফেলবে তীরে।
আর আমি তোর হাত শক্ত করে ধরে রাখব।
তোর কোন ভয় নেই।
আমরা সবাই পানিতে নামব, আর তুই পা ভিজাবি
তাই কখনো হয় নাকিরে বোকা।

উর্মির পানিতে নেমে সত্যিই খুব ভালো লাগছিল।
পানিতে নামার আগে সমুদ্রের বিশালতা সে ওভাবে অনুভব করতে পারেনি।
নামার পর মনে হচ্ছে সত্যি সমুদ্র বিশাল।

কয়েকটা ডেউ এসে ওদের মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল। তখনো জয়ি উর্মির হাত ধরে রেখেছিল।

কিন্তু হঠাৎ করে একটা বড়ো ঢেউ এসে দুজনকে আলাদা করে ফেললো।

ঢেউটা নেমে যাওয়া মাত্র জয়ি আবিস্কার করলো, উর্মি নেই।
নেই তো নেই।
সবাই মিলে খুব খোঁজাখুঁজি করেও ওকে পাওয়া গেল না।

চারদিকে যখন সবাই পাগলের মতো উর্মি কে খুঁজছে।
ঠিক সেই সময় বড়ো একটা ঢেউ এসে উর্মিকে আছড়ে ফেললো তীরে।

উর্মির কোন জ্ঞান নেই।
সবাই উর্মি কে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল।
অল্প সময়ের মধ্যে একজন ডাক্তার ও চলে আসলো।

উর্মির পেট থেকে পানি বের করে ফেলার পর ওর জ্ঞান ফিরে আসলো।

সেদিন উর্মি রুমে ফিরে আসার পর খুব পাগলামি করলো, সে ঢাকা ফিরে যেতে চায়।
তার খুব ভয় করছে।

সবাই মিলে অনেক বুঝানোর পর ও শান্ত হলো।
বিকেলে যখন সবাই ঘুরতে বের হলো, তখন উর্মি কিছুতেই যেতে রাজি হলো না।
ও একা একা রুমেই থাকতে চায়।

রুবাইদা ম্যাম ওকে অনেক বুঝালো, দেখো উর্মি, আজ তোমার সাথে যেটা ঘটেছে সেটা একটা দূর্ঘটনা ছাড়া কিছুই নয়।আমরা মাত্র তিন দিনের ট্যুরে আসছি।
আনন্দ করো।
এমন মন খারাপ করে বসে থাকলে চলবে।

এতো বোঝানোর পর ও উর্মিকে কেউ রুম থেকে বের করতে পারলো না।

সেদিন উর্মি রাতে কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে গেল।

উর্মি দেখলো, খুব সুদর্শন একটা ছেলে সমুদ্র থেকে হেঁটে হেঁটে ওর দিকে এগিয়ে আসছে।
ছেলেটা নিঃসন্দেহে সুপুরুষ। শরীরে এতো টুকু মেদ নেই। পিটানো শরীর। তবে গায়ে কোন কাপড় নেই। শুধু একটা নেংটি টাইপের কিছু মাজার সাথে পেঁচানো।

উর্মি তীরে বসে ছিল।
ছেলেটি এসে হাত বাড়িয়ে দিল।
গমগমে কন্ঠে বললো, উর্মি এসো, আমি তোমাকে নিতে এসেছি।

উর্মি নিজের অজান্তেই উঠে ছেলেটির হাত ধরে পানিতে নামা শুরু করলো।
শুধু একবার বললো, আমি তো সাঁতার জানি না, আমার একটু ভয় ভয় করছে।

ছেলেটি তার পুরুষালি ভরাট কন্ঠে বললো, কোন ভয় নেই উর্মি।
আমি আছি তো তোমার পাশে। তুমি চোখ বন্ধ করো।

উর্মি পরম নির্ভরতায় ছেলেটির হাত ধরে চোখ বন্ধ করে হাঁটা শুরু করলো।

এখন চোখ খুলো উর্মি।

উর্মি চোখ খুলে দেখলো, গভীর সমুদ্রের জলরাশির নিচে ছোট ছোট অনেক ঘর।
চারদিকে অনেক মানুষ, সবাই খুব আগ্রহ করে উর্মিকে দেখছে।
প্রতিটা মানুষের শরীর পেটানো, কোন মেদ নেই।
নেংটি ছাড়া কোন কাপড় নেই।

উর্মি ছেলেটির হাত শক্ত করে চেপে ধরলো। ভয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
আমি ফিরে যেতে চাই।
আমার খুব ভয় করছে।

ছেলেটি খুব মিষ্টি করে হেসে বললো, কোন ভয় নেই উর্মি। অবশ্যই যাবে, আমি তোমাকে পৌঁছে দিব।
আজ তুমি তোমার আসল ঠিকানা দেখে গেলে।
তোমাকে আবার আসতে হবে, আমার কাছে ফিরে আসতে হবে।
তোমার জন্ম শুধু আমার জন্য।

কথাগুলো বলে ছেলেটি একটা রুপালি কালারের চেন টাইপ ব্রেসলেট পরিয়ে দিলো উর্মির হাতে।

উর্মি কিছুতেই সেটা পরবে না, ও খুব হাত টানাটানি করছে।
হাতে খুব ব্যাথা লাগছে। ছেলেটার শরীরে যে অনেক শক্তি, সেটা হাত ধরে রাখা দেখলেই বোঝা যায়।

উর্মি নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে লাফিয়ে উঠে বসলো।

পুরো রুম অন্ধকার, সবাই ঘুমাচ্ছে।
তারমানে ও স্বপ্ন দেখছিলো এতোক্ষণ। ওর বুকের মধ্যে এখনো ড্রাম বাজার মতো শব্দ হচ্ছে।
যেন এখনি হৃদপিন্ডটা বের হয়ে আসবে।
ও খেয়াল করলো ওর জামা একদম ভেজা। এইমাত্র পানি থেকে উঠে আসলে যেভাবে টুপ টুপ করে পানি পরে, ঠিক সেভাবেই পানি ঝড়ে পরছে।
প্রচন্ড রকম ঘাবড়ে গিয়ে ও সাথে সাথে আলো জ্বালালো।

ও আর জয়ি এই রুমে ঘুমিয়েছে।
আলো জ্বালানোর সাথে সাথে জয়ি চোখ হাত দিয়ে ঢেকে বিরক্ত হয়ে বললো, কি শুরু করলি উর্মি!
লাইটটা অফ কর।

উর্মি ভয়ে খাট থেকে ও নামতে পারছে না। ওর পুরো শরীর ভয়ে ছমছম করছে।
ও ফিসফিসিয়ে বললো, জয়ি একটু আমার কাছে আসবি?
আমার খুব ভয় করছে। মনে হচ্ছে এখনি অজ্ঞান হয়ে যাবো।

জয়ি চোখ বন্ধ করেই বললো, রাত দুপুরে নাটক করিস না তো।
এমনিতেই আজ রাত জেগে আড্ডা দিয়ে একটু আগে ঘুমাতে আসছি।
আবার ভোরে সূর্যোদয় দেখতে যাবো।
লাইট অফ করে ঘুমা।

জয়ি প্লিজ একটু আয় আমার কাছে। দেখ আমি কেমন কাঁপছি। আমি মরে যাচ্ছি জয়ি, আমি মরে যাচ্ছি।

উর্মির এ ধরনের কথা শুনে জয়ি লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসলো, তারপর পূর্ণ দৃষ্টিতে উর্মির দিকে তাকালো।
যখন কেউ পূর্ণ দৃষ্টিতে কারো দিকে তাকায়, তখন তার ভেতরের পুরোটাই পড়ে ফেলা যায়।

জয়ি দেখলো, উর্মির পুরো শরীর ভিজে টপটপ করে পানি পরে বিছানার অনেকটাই ভিজে গেছে।
ও ভয়ে থরথর করে কাঁপছে।
ঠোঁট দুটো নীল হয়ে গেছে।

জয়ি ছুটে এসে উর্মিকে জড়িয়ে ধরলো।
কি হয়েছে তোর?
এমন করছিস কেন?
এই মাঝরাতে গোসল করার কারণ কি?

উর্মি জয়িকে কাছে পাওয়া মাত্র জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে কাঁদতে স্বপ্নে দেখা ঘটনা টা বললো।

উর্মির কথা শুনে জয়ি হেসেই বাঁচে না।
ধুর পাগল, এমন হয় নাকি।
তুই স্বপ্ন দেখছিস।
আর ভয়ে নিজের অজান্তেই গোসল করে এসে বিছানায় উঠছিস চেন্জ না করেই।

উর্মি নিজেও খুব অবাক!
সত্যিই কি তাই?
আমি কি তাহলে গোসল করছি!
হঠাৎ করে ওর হাতের দিকে চোখ পড়তেই ও লাফিয়ে উঠলো।
এই দেখ আমার হাতে ব্রেসলেটটা দেখ।
ঐ ছেলেটা এটা পরিয়ে দিয়েছে।

এবারো উর্মি শব্দ করে হেসে উঠলো।
তুই আসলেই পাগল হয়েছিস। এটা কি কখনো সম্ভব?
নিশ্চয়ই এটা তোর, তুই হয়তো নিজেই পরছিস কোন এক ফাঁকে। এখন মনে করতে পারছিস না।

উর্মি খুব দিশেহারা বোধ করছে।
তুই বুঝতে পারছিস না। আমার এমন কোন ব্রেসলেট নেই।
আর এই যে দেখ, আমার হাতে পাঁচ আঙুলের চেপে ধরার দাগ বসে গেছে।
এটাও কি আমার নিজের করা?

এবার জয়ি চুপ হয়ে গেছে।
সত্যিই তো উর্মির ফর্সা হাতে আঙ্গলের দাগ গুলো কফি কালার হয়ে আছে।

ও কি বলে উর্মিকে শান্তনা দিবে নিজেও বুঝতে পারছে না।

উর্মি কে স্বাভাবিক করার জন্য বললো, আয় তোকে চেন্জ করে দেই।
তারপর দুজনে এক খাটে জড়াজড়ি করে ঘুমাবো।

আমার আর ঘুম আসবে না রে।
খুব ভয় করছে।

ধুর পাগল, কোন ভয় নেই।
আমি তোর মাথায় বিলি কেটে দিব। আমার হাতে জাদু আছে।
দেখবি পাঁচ মিনিটের মধ্যে তোর ঘুম চলে আসবে।

এক সপ্তাহ পর।

উর্মি কক্সবাজার থেকে ফিরে আসার পর একদিনের জন্য ও ঘর থেকে বের হয়নি।
সবসময় মনমরা হয়ে থাকে। ঠিক মতো খাওয়া ঘুম নেই। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে।

উর্মির ছোট খালা বিখ্যাত সায়কোলজিস্ট জায়মা খান তার আপুর কাছে সব ঘটনা শুনছে।
কিন্তু কাজের চাপে আদরের ভাগ্নির কাছে আসার সময় বের করতে পারছিলো না।

শুক্রবার সকালে সে এসে হাজির।

উর্মির মা বোনকে দেখেই কেঁদে ফেললো।
আমার খুকিকে তুই ঠিক করে দে জায়মা।
আমি আর সহ্য করতে পারছি না।

আপা শান্ত হও।
আমি ওর রুমে যাচ্ছি।
তোমরা এসো না। আমি একা কথা বলতে চাই।
সব ঠিক হয়ে যাবে, এতো ভেবো না।

খালামনির সাথে উর্মির সম্পর্ক টা বন্ধুর মতো।
খালামনিকে দেখলেই সে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে সবসময়।
আজ সে যেভাবে বসে ছিল, ঠিক সেভাবেই বসে আছে, শুধু চোখ তুলে চাইলো একবার।

জায়মা উর্মির পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে থুতনিটা উঁচু করে স্নেহের পরশ বুলিয়ে বললো
কিরে খুকি চেহারার একি হাল করেছিস!
হয়েছে টা কি?
একটা স্বপ্ন দেখে তুই ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিবি?
আশ্চর্য!

খালামনি তুমি বুঝতে পারছ না।
ঐ ছেলেটা প্রতিদিন স্বপ্নে আসে। ওদের বসবাস গভীর সমুদ্রে।
ও আমাকে ওদের কাছে নিয়ে যেতে চায়।

উফ খুকি তোর কাছে আমি এমনটা আশা করি না।
শোন আমি দুই দিনের ছুটি নিয়েছি।
আজকের ফ্লাইটে তুই আর আমি কক্সবাজার যাচ্ছি।
একমাত্র সেই সমুদ্রের কাছে গেলেই তোর এই ভয় ভাঙবে।

উর্মি চিৎকার দিয়ে দু হাতে মুখ ঢেকে বললো, না না।
আমি কিছুতেই আর কক্সবাজার যাবো না।
তুমি জানো না, পানি খেতে গেলে ও গ্লাসের মধ্যে সেই ছেলেটাকে দেখতে পাই।

জায়মা খান এক রকম জোর করেই উর্মিকে কক্সবাজার নিয়ে গেল।
সে খুব ভালো ভাবে বুঝতে পারছে, উর্মির মানসিক সমস্যা খুব বেড়ে গেছে।
ওর চিকিৎসা এই পানি থেকেই শুরু করতে হবে।

জায়মা যখন উর্মিকে অনেক বুঝিয়ে হাত ধরে পানিতে নামছিলো, সেই মুহুর্তে উর্মির চেহারা ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।

সে বার বার থেমে যাচ্ছিল, বার বার খালামনির হাতটা শক্ত করে ধরে অনুরোধ করেছে, খালামনি চলো ফিরে যাই।
আমার খুব ভয় করছে।
ও আমাকে নিয়ে যাবে আজ।
তুমি পারবে না এই রহস্য মানবের কাছ থেকে আমাকে উদ্ধার করতে।

কি পাগলামি করছিস খুকি!
কিছু হবে না।
আমি আছি না।
এই দেখ তোর হাতটা আমি কতো শক্ত করে ধরে….

জায়মা কথা শেষ করতে পারলো না।
তার আগেই বড়ো একটা ঢেউ এসে ওদের এলোমেলো করে দিল।

জায়মা পাগলের মত উর্মিকে খুঁজছে।
কিন্তু নেই।
উর্মি নেই।

জায়মার চোখ দিয়ে টপাস টপাস করে পানি পরছে, আর কানে শুধু একটা কথাই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ও আমাকে আজ নিয়ে যাবে খালামনি।
তুমি পারবে না এই রহস্য মানবের কাছ থেকে আমাকে উদ্ধার করতে।

(সম্পূর্ণ কাল্পনিক)

নিউজটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন




© All rights reserved © 2019